সর্বশেষ
প্রতিবেদক: BS Software
আপডেট: ৩৬ দিন আগে
অর্থনৈতিক উদ্বেগের তাড়নায় ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৫৫ শতাংশ বাংলাদেশি উন্মুখ হয়ে পড়েছিল বিদেশে পাড়ি জমাতে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লব–পূর্ববর্তী অবস্থা সম্পর্কে এ উপাত্ত উৎপাদিত না হলেও বিষয়টি ভুক্তভোগীদের অজানা ছিল না।
ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত পরিচালিত দ্য ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক জরিপে আরও দেখা যায়, প্রধানত জীবনযাত্রার সাংঘাতিক ব্যয় বৃদ্ধি এবং ‘চাকরি–বাকরি’ সংকটের কারণে প্রায় এক দশকে এ দেশে তারুণ্যের আশাবাদ নেমে গেছে ৬০ থেকে ৫১ শতাংশে; অন্য কথায়, বাংলাদেশের অর্ধেক তরুণই ছিল হতাশাগ্রস্ত।
এই হতাশার কিছুটা বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়, কোটাবিরোধী আন্দোলনের পরম্পরায় এবং সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চূড়ান্ত রাজনৈতিক পরিণতি ছিল ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন।
ওই ফ্যাসিবাদী জামানায় কর্মসংস্থানের অভাবে প্রতি ১০ জনের ৪ জন তরুণ (৪৪ শতাংশ) নিজেরাই ব্যবসা শুরু করতে উদ্গ্রীব ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয় সদ্য প্রকাশিত ব্রিটিশ কাউন্সিলের জরিপ ‘আগামী প্রজন্মের বাংলাদেশ’-এর প্রতিবেদনে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যেনতেনভাবে বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা নিবারণ কিংবা সফল উদ্যোক্তা হতে তরুণদের উৎসাহ প্রদানে রাষ্ট্রের হাত বাড়ানোর সবে পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
সুতরাং আজকের তরুণেরা আশা করতেই পারেন ‘তেলা মাথায় তেল’ দেওয়ার বদলে নতুনদের জন্য সহস্র প্রকারের লাখো সুযোগ উন্মোচিত হবে এবং ব্যক্তির উদ্যোগে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আর বাধা না হয়ে বরং প্রণোদনা হিসেবেই কাজ করবে।
একটু সহজ করে ভাবলে একজন তরুণ বিশেষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ছাড়াও যদি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন এবং তা প্রকাশ করেন, রাষ্ট্রের উচিত হবে তাঁকে ব্যবসার ধারণা থেকে শুরু করে লাইসেন্স প্রদান, ঋণ প্রাপ্তি ও অবকাঠামো সমর্থন থেকে পণ্য ও সেবা বাজারজাত করা পর্যন্ত সঠিক পথ দেখানো।
উদ্যোক্তা তৈরির একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নিতে পারে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার, যদি না দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকে এর ইনকিউবেটর কোন মন্ত্রণালয় বা বিভাগ দেখভাল করবে। শুধু প্রধান উপদেষ্টা নন, সামাজিক ব্যবসার প্রবক্তা হিসেবে তিনি তাঁর তাত্ত্বিক ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে বাংলাদেশের পরবর্তী অর্থনৈতিক রূপান্তরে নেতৃত্ব দিতে পারেন।
এই মহাপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে বৈচিত্র্যময় ক্ষুদ্র, মাঝারি ও মোটামুটি বড় আকারের শিল্পকারখানা, সেবা প্রতিষ্ঠান, ঘরে বসে ব্যবসা, ফ্রিল্যান্সিং, স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্ম, স্থানীয় জ্ঞানভিত্তিক ব্যবসা, উৎকর্ষের প্রতিযোগিতা, আবিষ্কারের প্রেরণা ও সৃজনশীল অজানা ব্যবসা।
এর যেকোনো বিষয়ে একজন উদ্যোক্তা সফল হলে খুব ভালো কিন্তু তার ব্যর্থ হওয়ারও কিছুটা স্বাধীনতা থাকা চাই, নইলে নতুন প্রজন্ম উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী হবে কোন সাহসে? রাষ্ট্রকে এ অভয়ও দিতে হবে যে ব্যবসার আমাজন নদীর বড় মাছ ছোটদের খেয়ে ফেলতে পারবে না।
ব্যবসার জগতেও ফ্যাসিবাদের অমানিশা শেষে যদি নতুন দিন আসে বাংলাদেশে তবে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার আশা করা কি খুব অযৌক্তিক? নিশ্চয়ই পুরোনো গোষ্ঠী প্রীতির রাজনৈতিক অর্থনীতি চালিয়ে নেওয়া সহ্য করার জন্য শুধু জুলাই-আগস্ট মাসেই হাজারো তরুণ-জনতা জীবন দান করেনি!
বিগত সরকারের আমলে ব্যবসায়ের বড় বড় সুযোগ নির্ধারিত ছিল যেসব গোষ্ঠীর কল্যাণে তারাই করপোরেট সামাজিক দায়িত্বের জন্য বরাদ্দ করা টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ইচ্ছেমতো উপহার (!) দিতেন, চুক্তি পেতে ক্ষমতাকেন্দ্রে অগ্রিম অর্থলগ্নি করতেন এবং জাতীয় সম্পদ পাচারে হাত লাগাতেন। ফলে তাদের নিজস্ব ব্যবসা ছিল একচেটিয়া ও বিনা কৈফিয়তে।
ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব উদ্যোক্তাদের সমর্থন দেওয়ার পরিবর্তে শাসক দল এবং রাজকীয় পরিবার তোষণে বেশি আসক্ত ছিলেন। সেই ফ্যাসিবাদী স্লোগানধারী ব্যবসায়ী নেতাদের নতুন উদ্যোক্তা তৈরির দায়িত্ব প্রদান হবে শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়ার শামিল।
বিনা ভোটে ‘নির্বাচিত’ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিল আমলাতন্ত্র, অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, কিছু পেশাদার দালাল, এক শ্রেণির ‘মিডিয়ার লোক’, কিছু বিদেশি এজেন্ট এবং সর্বোপরি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। এই সুবিধাভোগীদের একত্রে কেতাবি ভাষায় বলা হয় অলিগার্কি।
এই অলিগার্কিই যেহেতু জনগণের অধিকার পদদলিত করে ফ্যাসিবাদী সরকারব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে রক্তনালির মতো ভূমিকা রেখেছে, তাই তারা মনে করত তারাই সরকারের সবকিছু, এমনকি ‘মা–বাবা’ কারণ, তাঁরা ছিলেন ‘গৌরী সেন’ এবং আওয়ামী রাজত্বের অপরিহার্য সভাসদ।
তাঁরা সবাই ব্যবসায়ী না হয়েও রাষ্ট্রকে পারিবারিক ব্যবসার আদলে চালানোই ছিল তাঁদের ব্যবসা, বিনা পুঁজির ব্যবসা যথা চাঁদাবাজি, ঘুষ, কমিশন, চোরাচালান, দালালি এবং গুপ্তচরবৃত্তি, যেখানে তাঁদের আয় শতকোটি, হাজার কোটি টাকা।
অনেকেই এই প্রক্রিয়াকে স্বেচ্ছাচারী শাসনের কার্যকারণ হিসেবেই দেখেন।
সম্প্রতি দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সরকার গঠিত কমিটির এক পরামর্শ সভায় তুলে ধরা হয় এ রকম এক ধাঁধা (পাজল), অনাচারের অর্থনীতি সৃষ্টি করে স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি নাকি স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি সৃষ্টি করে অনাচারের অর্থনীতি?
অন্তত বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে পুরো ব্যাপারটি ছিল একটি স্বেচ্ছাচারী রাজনৈতিক কর্মসূচি (স্কিম) এবং এই পছন্দের সিদ্ধান্ত ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে থাকা শেখ হাসিনা নামক এক ব্যক্তির, যার আশীর্বাদে এবং যাকে টিকিয়ে রাখতে গড়া হয় ধামাধরা বা চামচা অর্থনীতি (ক্রনি ক্যাপিটালিজম)।
তাই বলে ‘খয়ের খাঁ’রাও দায় এড়াতে পারেন না, কারণ, তাঁরা দুরাচারের রাজনীতি এবং স্বেচ্ছাচারী নেতৃত্ব সমর্থন দিয়েছেন কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে নয়, নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির উচ্চাভিলাষে।
শ্বেতপত্র কমিটির সদস্যরাও একমত যে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এই দুষ্ট চক্রের সমর্থনে তৈরি করা হয় উন্নয়নের বয়ান। যে বয়ানের পক্ষে কিছু কিছু বিদেশিও কথা বলেছেন, হয়তো অর্থনৈতিক স্বার্থে অথবা বাংলাদেশিদের সম্পর্কে অজানা ভীতিতে (জেনোফবিয়া)।
এবারের বিপ্লবের আগের বাংলাদেশে, ব্রিটিশ কাউন্সিলের জরিপে উঠে আসে ৬০ শতাংশের মতো (৫৮ শতাংশ) তরুণ বিরাজমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল ছিল না।
অবশেষে বিপ্লবের ঝরে পড়া ফ্যাসিবাদী হাসিনার উন্নয়নের বয়ান এবং দুর্নীতির রাজত্ব ধরাশায়ী হয়েছে, চামচারাও গা ঢাকা দিয়েছেন।
সর্বশেষ নিয়ে আরও পড়ুন