সর্বশেষ
প্রতিবেদক: BS Software
আপডেট: ৩৮ দিন আগে
আমাদের সেই তরুণ সময়ের এক উজ্জ্বল দিন ছিল ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬২ সাল। সেদিন আইয়ুব শাসনবিরোধী সাহসী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেদিনের সেই ধর্মঘট আর মিছিলে আমিও ছিলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট হয়েছিল, মিছিল হয়েছিল, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল। এরপর প্রায় সপ্তাহজুড়ে ঢাকা এবং সারা দেশে এই ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, ১৪৪ ধারা জারি, হল অবরোধ, নির্বিচার গ্রেপ্তার এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই ছাত্র আন্দোলনের স্লোগান ছিল: সামরিক শাসন চাই না, কথা বলার অধিকার চাই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই, নির্বাচন চাই ও গণতন্ত্র চাই।
সেদিন যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র গণ-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল। সে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আইয়ুব সরকারের পতন হয়েছিল, শেখ মুজিবসহ রাজবন্দীরা মুক্তি পেয়েছিলেন এবং সামরিক সরকার সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল। তখন দেশে সামরিক শাসন থাকলেও সাহসী সাংবাদিকতা ছিল।
ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন শেষ করে ১৯৭০ সালে সাপ্তাহিকএকতাপত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলাম। সেটা তখন বেআইনি ঘোষিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ছিল। সে সময়ে সামরিক শাসনের মধ্যেও আমরা পত্রিকায় রাজনৈতিক অধিকার, নির্বাচন, গণতন্ত্র এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলেছি। সর্বশেষ ২৫ মার্চ রাতে পৃষ্ঠাজুড়ে ‘সর্বাত্মক লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হউন’ শিরোনামে পত্রিকা বের করেছিলাম। ২৬ মার্চ সে পত্রিকা আর বিলি হতে পারেনি। ততক্ষণে আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা তখন এক নতুন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে দিনরাত কাজ করেছি। আবার বাহাত্তর সালের ফেব্রুয়ারিতে নতুন করে সাপ্তাহিকএকতাপত্রিকা বের করেছি।
আশা করেছিলাম, ১৯৭৩ সালের সংবিধান অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। কিন্তু ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে জরুরি আইন জারি এবং ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় বড় পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়ে শেখ মুজিব একদলীয় বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ) শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। দেশে সে সময় চারটি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের সাপ্তাহিকএকতাও বন্ধ হয়ে যায়। সেই ’৬২ সাল থেকে যে দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছি, স্বাধীন বাংলাদেশে সাড়ে তিন বছরের মাথায় এসে সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেল। সংগঠন করার স্বাধীনতা থাকল না। গণতন্ত্রও রইল না। প্রতিষ্ঠিত হলো একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবার শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ও সামরিক শাসন জারি হলে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। সারা দেশে এক অস্বাভাবিক ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পরে সামরিক শাসক জিয়ার শাসনামলে দেশে রাজনীতি পুনঃপ্রচলনের সময়েএকতাপুনঃপ্রকাশের অনুমতি পাওয়া যায়। ১৯৭৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথম শুক্রবার সাপ্তাহিকএকতাপুনঃপ্রকাশিত হয়। আমরা নতুন উদ্দীপনা নিয়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হই। সেই দিনগুলোতে বহু বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অনেক সাহস নিয়ে সাংবাদিকতার কাজ করতে হয়েছে।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবার জটিল হয়ে পড়ে। শুরু হয় এরশাদের স্বৈরশাসন। ১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর ১৫ মে এরশাদের নির্দেশে সাপ্তাহিকএকতাবন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রায় ১০ মাস বন্ধ থাকার পর ১৯৮৭ সালের মার্চে আবারএকতাচালু হয় এবং এরশাদের পতনের গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
শেষ পর্যন্ত এরশাদের পতনের পর সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। তার কিছুদিন পর ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমরা নব উদ্যমে দৈনিকভোরের কাগজ-এর প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে নতুন পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করি। তখন নতুন সময়ে নতুন প্রত্যাশায় আমরা দৃঢ়ভাবে দলনিরপেক্ষ ও স্বাধীন সংবাদপত্র হিসেবে দৈনিকভোরের কাগজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করি।
মনে পড়ে, ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপি সরকারভোরের কাগজ-এর সব সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছিল। কারণ, আমরা বিএনপি সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যক্রম ও দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ এবং সমালোচনা করছিলাম। সরকারি বিজ্ঞাপন ফিরে পেতে বহুমুখী আন্দোলন, এমনকি আমরা রাস্তায় মিছিলও করেছি। সে সময় আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধি ও আমার বিরুদ্ধে বগুড়া, সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ অনেক জায়গায় মামলা হয়েছে। জামিন পেতে জেলায় জেলায় যেতে হয়েছে।
১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। তারা সরকার গঠন করে। আমরাভোরের কাগজপত্রিকায় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা অব্যাহত রাখি। কিন্তু আবার আমরা স্বাধীন সাংবাদিকতার কাজে বাধাগ্রস্ত হই। কারণ,ভোরের কাগজ-এর প্রকাশক তখন সরকারি দলের সংসদ সদস্য ও পরে উপমন্ত্রী হন। সরকারের চাপ তিনি আর নিতে পারেননি, শেষ পর্যন্তভোরের কাগজছেড়ে চলে আসি আমরা।
নতুন করে স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে আমরা আবার শতাধিক সহকর্মী নিয়েপ্রথম আলোপ্রকাশ করি এবং দৃঢ়ভাবে স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতা শুরু করি। সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করি এবং পাশাপাশি সরকারের ব্যর্থতাও তুলে ধরার চেষ্টা করি। একই সঙ্গে বিরোধী দলের অগণতান্ত্রিক রাজনীতির সমালোচনাও করি।
২০০০ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারওপ্রথম আলোর সব সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ এবং প্রথম আলো ডটকম অনলাইন সংস্করণও বন্ধ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত ২০০১ সালে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে সরকারি বিজ্ঞাপন আবার চালু হয় এবং অনলাইনের জন্যও নতুনভাবে অনুমতি পাওয়া যায়।
পাঠকদের একটি ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিই। ২০০১ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন ইউএনবির ফেনীর সাংবাদিক টিপু সুলতানকে ফেনীতে আক্রমণ করে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে রেখে যায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারীর অনুসারীরা।প্রথম আলোএ নিয়ে জোরালোভাবে সংবাদ ও মতামত প্রচার করে। আমরা টিপু সুলতানের চিকিৎসার জন্য তহবিল সংগ্রহ করি। সাংবাদিক টিপু সুলতানকে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাংককে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। তাঁর হাতে-পায়ে আটবার অস্ত্রোপচার হয়েছিল।
সর্বশেষ নিয়ে আরও পড়ুন